সাকিব আঞ্জুমান সুস্মিত, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার :
বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল, যার পরিচিতি “চায়ের রাজধানী” হিসেবে, বহন করে শত বছরের ইতিহাস। এই ইতিহাসে যেমন রয়েছে সবুজে মোড়া চা-বাগানের সৌন্দর্য, তেমনি রয়েছে সহস্র শ্রমিকের ঘাম, চোখের জল আর নিঃশব্দ বঞ্চনার দীর্ঘ অধ্যায়।
শুরুটা ছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৮৫০-এর দশকে ব্রিটিশরা ভারতের ছত্তিশগড়, ওড়িশা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীকে চুক্তির ফাঁদে ফেলে শ্রীমঙ্গলে নিয়ে আসে। তারা ছিল তথাকথিত “বাঁধা শ্রমিক”—চা বাগানের জন্য আমৃত্যু নিযুক্ত এক শ্রেণির মানুষ, যাদের নাগরিক অধিকার ছিল না, মালিকানার অধিকার ছিল না, এমনকি বাগান ছাড়ার স্বাধীনতাও ছিল না। দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কঠোর শ্রমের বিনিময়ে তারা পেত সামান্য খাদ্য, চিকিৎসা ছিল প্রায় অনুপস্থিত। এই শোষণচক্র প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে, আর রাষ্ট্রের মূল উন্নয়নধারার বাইরে থেকেছে এই জনগোষ্ঠী।
স্বাধীনতার পরেও রাষ্ট্র দীর্ঘ সময় চা শ্রমিকদের প্রতি উদাসীন ছিল। কিন্তু বড় পরিবর্তন আসে যখন ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরে ২০০৯ থেকে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে এবং নীতিগত অগ্রাধিকারের ফলে চা শ্রমিকদের জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। শুরু হয় মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগ, চালু হয় রেশন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যায় দূরবর্তী বাগানে এবং সন্তানদের জন্য স্কুল ও উপবৃত্তি দেওয়া হয়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে, যখন চা শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি তদারকি করেন এবং তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করেন। এটি ছিল শুধু আর্থিক সহায়তা নয় বরং এক ধরনের নৈতিক স্বীকৃতি, যে এই শ্রমিকরাও রাষ্ট্রের নাগরিক, তাদেরও অধিকার রয়েছে সম্মানের সাথে বাঁচার। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বাগানে আধাপাকা ঘর নির্মাণ, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, মোবাইল চিকিৎসা ইউনিট, নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং বাগানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল গঠন করা হয়।
কিন্তু ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট এক রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাত হলে, এই অগ্রযাত্রায় ছেদ পড়ে। চা শ্রমিকদের ভাগ্যে আবারও ফিরে আসে সেই পুরনো বঞ্চনার চিত্র। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থমকে যায়, রেশনিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে, মজুরি দেওয়া হয় অনিয়মিতভাবে। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি হ্রাস পাওয়ায় মালিকপক্ষ আবার আগের মত শক্ত অবস্থানে ফিরে যায়, শ্রমিকদের অভিযোগ অগ্রাহ্য করা হয়, এবং শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ চা বাগানের এক নারী শ্রমিক রাধা সোরেন জানান, “আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় ডাক্তার আসত, চাল-ডাল পেতাম সস্তায়, এখন তো কিছুই পাই না। মাইনেরও ঠিক নাই, অসুখ হলেও ওষুধ নাই।”
অন্যদিকে বাগানের স্কুলগুলোতেও শিক্ষক সংকট প্রকট হয়েছে। শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অনেক এলাকায় সরকারি মেডিকেল ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেছে, নতুন ঘর নির্মাণ থেমে গেছে, পুরনো ঘরগুলো সংস্কার না হওয়ায় বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চা শ্রমিকদের সংগঠনের নেতারা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০ বছরের উন্নয়ন কয়েক মাসেই ধ্বংস হয়ে যাবে। শেখ হাসিনার সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার করেছিল, তা এখন ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে।
শ্রীমঙ্গলের চা শ্রমিকরা আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে তারা অতীতের শোষণের ছায়া আবার স্পষ্টভাবে অনুভব করছেন। যেসব শ্রমিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তারা আজ চোখে অন্ধকার দেখছেন। রাষ্ট্র যদি দ্রুত চা শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে বাংলাদেশ তারই এক অনন্য শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে চিরতরে হারাতে বসেছে।
.
রিপোর্টার্স২৪/এস