রিপোর্টার্স২৪ ডেস্ক :
গাজার শাথি অঞ্চলের একটি জনাকীর্ণ শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতরে বসে আছেন ৩০ বছর বয়সী নারী রানিম আবুল ঈস। দমবন্ধ হওয়া পরিবেশে তিনি তাঁর দুই বোনের সেবাযত্ন করছেন। তাঁরা হলেন ৫১ বছর বয়সী আসিল ও ৩৩ বছর বয়সী আফাফ। তাঁরা রানিমের কাছাকাছি বসে আছেন এবং হাসছেন।
তবে বাইরে খেলাধুলা করা শিশুদের কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেলে তাঁরা অস্থির হয়ে উঠছেন।
আসিল ও আফাফ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাঁরা দুরারোগ্য সিলিয়াক রোগে আক্রান্ত। এই রোগের কারণে তাঁদের কথা, বুঝ-বুদ্ধি ও আচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধ পরিস্থিতি তাঁদের সমস্যা আরো জটিল করেছে। রানিম বলেন, তাঁরা নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। তবে তাঁরা প্রায় পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হন। রানিমের ধারণা, তাঁর দুই বোন ট্যুরেট সিনড্রোমে আক্রান্ত।
একটি সংকীর্ণ তাঁবুতে রানিমের পরিবারের সাত সদস্য বসবাস করেন। তাঁরা হলেন রানিম, তাঁর দুই বোন, তাঁদের বৃদ্ধ মা-বাবা এবং তাঁর আরেক বোন ও বোনের স্বামী। রানিমের মা দুর্বল হয়ে গেছেন। বাবা ইসরায়েলের বোমার আঘাতে আহত। ফলে অসুস্থ দুই বোনের দেখাশোনা রানিমকেই করতে হয়।
ইসরায়েলি বাহিনী তাঁদের ঘর ধ্বংস করার আগ পর্যন্ত তাঁরা জাবালিয়া ক্যাম্পে বসবাস করতেন। সেখান থেকে বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করে আসছেন। এখন তাঁবুই তাঁদের আশ্রয়, যেখানে তাঁদের দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম এবং রাতে শীত ভোগ করতে হয়। এই তাঁবুতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিত্ব রক্ষা করে চলা কঠিন। রানিমের ভাষায়—যখন আমাদের কারো পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তখন অন্যদের বের করে আনতে হয়। কিন্তু সেটা সব সময় সম্ভব হয় না। এটা আসিল ও আফাফের অগ্নিপরীক্ষার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
আসিল ও আফাফ তাঁদের অবস্থার জন্য প্রতিদিন মানুষের নানা কথা শোনেন। মানুষ তাঁদের কষ্ট অনুভব করতে পারে না, তারা বুঝতে চায় না তাঁদের যত্ন, সহমর্মিতা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রয়োজন। ক্যাম্পের জীবন আসিলকে অতিষ্ঠ করে তোলে। তিনি কোলাহল ও আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। যখন এমন কিছু হয় চিৎকার করেন, কান্না করেন এবং কখনো কখনো অন্যকে আঘাত করেন। আফাফও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও আচরণে কষ্ট পান। সামান্য বিতর্ক ও উচ্চ আওয়াজ তাঁর মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। সামাজিক টয়লেট ব্যবহার করাও এই দুই বোনের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।
যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির পর রানিমের পরিবারে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ছয় মাস আগে। যখন ২২ বছর বয়সী তাঁদের ভাই মুহাম্মদ রানিমকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করে নিয়ে যায়। ইসরায়েলের বোমা হামলায় আহত হয়ে কামাল আওদান হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে অভিযান চালানোর সময় তাঁকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করে। এর পর থেকে তাঁর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। ভাই-বোনের ভেতর মুহাম্মদই ছিল বাইরের জগতে চলাচলের সবচেয়ে উপযোগী। তিনি তাঁদের জন্য ওষুধ সংগ্রহ করতেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতেন এবং বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ফলে তাঁকে ছাড়া পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন তাদের জন্য কষ্ট করার কেউ নেই।
মার্চ থেকে মে মাসে ইসরায়েল পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করার পর গাজার জনজীবনে চরম সংকট তৈরি হয়। সেখানে প্রচণ্ড খাদ্য ও ওষুধ সংকট দেখা দেয়। আসিল ও আফাফ এখন তাঁদের প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং মৌলিক পুষ্টি থেকেই বঞ্চিত। সিলিয়াকে আক্রান্তদের জন্য গ্লুটেন খাওয়া নিষিদ্ধ। কেননা এটা তাদের ক্ষুদ্রান্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেখানে গাজায় গ্লুটেনযুক্ত আটা-ময়দার রুটি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না, সেখানে রানিমের পক্ষে বোনদের জন্য সবজি ও গোশত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, বিশেষত মুহাম্মদ আটক হওয়ার পর। আসিল ও আফাফের জন্য বিশেষ খাদ্যসূচি, ওষুধ ও নিয়মিত থেরাপি দেওয়া আবশ্যক, যা এখন সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। আলজাজিরা অবলম্বনে
.
রিপোর্টার্স২৪/এস