কালাম আজাদ, ইতালি প্রতিনিধি : হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভারতের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত হিন্দি সিনেমাটি মুক্তির ৫০ বছর পর আবার বড় পর্দায় আসছে।
১৯৭৫ সালে নির্মিত রমেশ সিপ্পির এই কালজয়ী সিনেমা এবার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এতে রয়েছে সিনেমার আসল শেষাংশ ও কিছু বাদ দেওয়া দৃশ্য। এই নতুন সংস্করণটি ইতালির বোলোনিয়ায় আজ শুক্রবার (২৭ জুন) ইল সিনেমা রিট্রোভাতায় প্রথমবার দেখানো হবে। এটি বড় এক খোলা জায়গায় স্ক্রিনে দেখানো হবে, যা হতে যাচ্ছে দর্শকদের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
সালিম-জাভেদ এ ছবির কাহিনি লিখেছেন। অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, জয়া ভাদুরী, সঞ্জীব কুমার ও ‘গব্বর সিং’ চরিত্রে আমজাদ খান। এর কাহিনি পশ্চিমা ও জাপানি সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হলেও এটি পুরোপুরি ভারতীয় আবহে তৈরি।
এই ২০৪ মিনিটের ছবিতে ভালো-খারাপের চিরাচরিত লড়াই দেখানো হয়েছে। রামগড় নামে এক কাল্পনিক গ্রামে দুই চোর—জয় ও বীরুকে ডাকাত গব্বর সিংয়ের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নিয়োগ দেন এক সাবেক পুলিশ, ঠাকুর বলদেব সিং।
মুক্তির পর ‘শোলে’ মুম্বাইয়ের মিনার্ভা হলে টানা পাঁচ বছর চলে। সিনেমাটি বিবিসি ইন্ডিয়ার জরিপে ‘শতাব্দীর সেরা সিনেমা’ হয় এবং ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এটি ভারতের সেরা সিনেমা হিসেবে ঘোষণা করে। এর গান ও সংলাপের ক্যাসেট ও রেকর্ড অর্ধমিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়েছিল। এটি শুধু যেন একটি সিনেমা নয়, বরং হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির প্রতীক। এর সংলাপ বিয়েতে বলা হয়, রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়, এমনকি বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা যায়।
‘শোলে” বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য,’ বলেছেন ধর্মেন্দ্র। অমিতাভ বচ্চন বলেছেন, ‘এই সিনেমা শুট করার সময় বুঝিনি এটা এত বিখ্যাত হবে, তবে এটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় সময় ছিলো।’
শিবেন্দ্র সিং দুংগারপুর জানান, এবারকার সংস্করণই সবচেয়ে আসল ও সম্পূর্ণ। এখানে মূল শেষাংশ ও বাদ দেওয়া দৃশ্যগুলো রয়েছে।
প্রথমে সিনেমার শেষাংশে ঠাকুর গব্বরকে হত্যা করত। কিন্তু সেন্সর বোর্ড এতে আপত্তি করে। তারা মনে করেছিল, একজন সাবেক পুলিশ এভাবে আইন নিজের হাতে নিতে পারে না। সেই সময় দেশে জরুরি অবস্থা চলছিল, তাই সেন্সরের নিয়ম ছিলো অনেক কড়া। শেষে রমেশ সিপ্পি সিনেমার শেষাংশ পরিবর্তন করে দেখান, গব্বর ধরা পড়ে, মারা যায় না। তারপরই সিনেমাটি সেন্সরের ছাড়পত্র পায়।
এই সিনেমার পুরোনো প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ক্যামেরা নেগেটিভও অনেক খারাপ ছিল। ২০২২ সালে রমেশ সিপ্পির ছেলে শহজাদ সিপ্পি ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, মুম্বাইয়ের এক গুদামে কিছু কৌটা আছে। সেখানে পাওয়া যায় ছবির মূল ক্যামেরা ও সাউন্ড নেগেটিভ।
এরপর যুক্তরাজ্য থেকেও কিছু অতিরিক্ত রিল পাওয়া যায়। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ইতালির লা ইমাজিনে রিট্রোভাতার সাহায্যে ছবির সব অংশ জোড়া লাগানো হয়। এমনকি এই সিনেমাতে ব্যবহৃত আসল ক্যামেরাটিও উদ্ধার করা হয়।
তবে প্রথম মুক্তির সময় ‘শোলে’ তেমন প্রশংসা পায় নি। অনেক সমালোচক সিনেমাটি ব্যর্থ বলেছিলেন। ইন্ডিয়া টুডে সিনেমাটিকে বলেছিল ‘নিভে যাওয়া কয়লা।’
ফিল্মফেয়ারের এক লেখক বলেছিলেন, ‘এটি না ঠিক ভারতীয়, না ঠিক পশ্চিমা।’
প্রথম সপ্তাহে হলে দর্শক ছিলো নীরব। অনুপমা চোপড়া তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘দর্শকেরা চুপচাপ বসে থাকত—না হাসি, না কান্না, না হাততালি।’ তৃতীয় সপ্তাহে দর্শক সংলাপ বলতে শুরু করে, মানে অনেকে দ্বিতীয়বার দেখতে আসে।
এক মাস পর একটি সংলাপ রেকর্ড বের হয়, যেটা খুব জনপ্রিয় হয়। এরপরই সিনেমাটি ঘুরে দাঁড়ায়। গব্বর সিং চরিত্র ভয়ংকর হলেও খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
‘শোলে’ টানা পাঁচ বছরের বেশি মিনার্ভা হলে চলে—তিন বছর নিয়মিত শো, দুই বছর ম্যাটিনি শো। এমনকি ২৪০তম সপ্তাহেও হলে ভিড় ছিলো। পাকিস্তানে সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১৫ সালে এবং তখনো অনেক নতুন ছবিকে হারিয়ে দেয়। সিনেমা পরিবেশক শ্যাম শ্রফ বলেন, ‘যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে বলা হয়, “শোলে” নিয়েও বলা যায়—সূর্য কখনো অস্ত যায় না।’
হিন্দি সিনেমার আশ্চর্য লেখক-জুটির গল্প
‘শোলে’ এখনো মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে কেন? অমিতাভ বচ্চনের উত্তর, ‘অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের বিজয় আর সবচেয়ে বড় কথা, তিন ঘণ্টায় ন্যায়বিচার! যা আপনি আর আমি আজীবনেও না–ও পেতে পারি।’